সোমবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১২

সেই রাত্রির কল্পকাহিনী ---------নির্মলেন্দু গুণ

  • সেই রাত্রির কল্পকাহিনী
  • ---------নির্মলেন্দু গুণ
  • তোমার ছেলেরা মরে গেছে প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে,
  • তারপর গেছে তোমার পুত্রবধূদের হাতের মেহেদী রঙ,
  • তারপর তোমার জন্মসহোদর, ভাই শেখ নাসের
  • তারপর গেছেন তোমার প্রিয়তমা বাল্যবিবাহিতা পত্নী,
  • আমাদের নির্যাতিতা মা।
  • এরই ফাঁকে একসময় ঝরে গেছে তোমার বাড়ির
  • সেই গরবিনী কাজের মেয়েটি, বকুল।
  • এরই ফাঁকে একসময় প্রতিবাদে দেয়াল থেকে
  • খসে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের দরবেশ মার্কা ছবি।
  • এরই ফাঁকে একসময় সংবিধানের পাতা থেকে
  • মুছে গেছে দু’টি স্তম্ভ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।
  • এরই ফাঁকে একসময় তোমার গৃহের প্রহরীদের মধ্যে
  • মরেছে দু’জন প্রতিবাদী, কর্ণেল জামিল ও নাম না-জানা
  • এক তরুণ, যাঁর জীবনের বিনিময়ে তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলো।
  • তুমি কামান আর মৃত্যুর গর্জনে উঠে বসেছো বিছানায়,
  • তোমার সেই কালো ফ্রেমের চশমা পরেছো চোখে,
  • লুঙ্গির উপর সাদা ফিনফিনে ৭ই মার্চের পাঞ্জাবী,
  • মুখে কালো পাইপ, তারপর হেঁটে গেছো বিভিন্ন কোঠায়।
  • সারি সারি মৃতদেহগুলি তোমার কি তখন খুব অচেনা ঠেকেছিলো?
  • তোমার রাসেল? তোমার প্রিয়তম পত্নীর সেই গুলিবিদ্ধ গ্রীবা?
  • তোমার মেহেদীমাখা পুত্রবধুদের মুজিবাশ্রিত করতল?
  • রবীন্দ্রনাথের ভূলুন্ঠিত ছবি?
  • তোমার সোনার বাংলা?
  • সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবার আগে তুমি শেষবারের মতো
  • পাপস্পর্শহীন সংবিধানের পাতা উল্টিয়েছো,
  • বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে এক মুঠো মাটি তুলে নিয়ে
  • মেখেছো কপালে, ঐ তো তোমার কপালে আমাদের হয়ে
  • পৃথিবীর দেয়া মাটির ফোঁটার শেষ-তিলক, হায়!
  • তোমার পা একবারও টেলে উঠলো না, চোখ কাঁপলো না।
  • তোমার বুক প্রসারিত হলো অভ্যুত্থানের গুলির অপচয়
  • বন্ধ করতে, কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য
  • একজন কৃষকের এক বেলার অন্নের চেয়ে বেশি।
  • কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য একজন
  • শ্রমিকের এক বেলার সিনেমা দেখার আনন্দের চেয়ে বেশি।
  • মূল্যহীন শুধু তোমার জীবন, শুধু তোমার জীবন, পিতা।
  • তুমি হাত উঁচু করে দাঁড়ালে, বুক প্রসারিত করে কী আশ্চর্য
  • আহবান জানালে আমাদের। আর আমরা তখন?
  • আর আমরা তখন রুটিন মাফিক ট্রিগার টিপলাম।
  • তোমার বক্ষ বিদীর্ণ করে হাজার হাজার পাখির ঝাঁক
  • পাখা মেলে উড়ে গেলো বেহেশতের দিকে…।
  • … তারপর ডেডস্টপ।
  • তোমার নিষ্প্রাণ দেহখানি সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে, গড়াতে, গড়াতে
  • আমাদের পায়ের তলায় এসে হুমড়ি খেয়ে থামলো।
  • – কিন্তু তোমার রক্তস্রোত থামলো না।

  • সিঁড়ি ডিঙিয়ে, বারান্দার মেঝে গড়িয়ে সেই রক্ত,

  • সেই লাল টকটকে রক্ত বাংলার দূর্বা ছোঁয়ার আগেই

আমাদের কর্ণেল সৈন্যদের ফিরে যাবার বাঁশি বাজালেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন