- সেই রাত্রির কল্পকাহিনী
- ---------নির্মলেন্দু গুণ
- তোমার ছেলেরা মরে গেছে প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে,
- তারপর গেছে তোমার পুত্রবধূদের হাতের মেহেদী রঙ,
- তারপর তোমার জন্মসহোদর, ভাই শেখ নাসের
- তারপর গেছেন তোমার প্রিয়তমা বাল্যবিবাহিতা পত্নী,
- আমাদের নির্যাতিতা মা।
- এরই ফাঁকে একসময় ঝরে গেছে তোমার বাড়ির
- সেই গরবিনী কাজের মেয়েটি, বকুল।
- এরই ফাঁকে একসময় প্রতিবাদে দেয়াল থেকে
- খসে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের দরবেশ মার্কা ছবি।
- এরই ফাঁকে একসময় সংবিধানের পাতা থেকে
- মুছে গেছে দু’টি স্তম্ভ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।
- এরই ফাঁকে একসময় তোমার গৃহের প্রহরীদের মধ্যে
- মরেছে দু’জন প্রতিবাদী, কর্ণেল জামিল ও নাম না-জানা
- এক তরুণ, যাঁর জীবনের বিনিময়ে তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলো।
- তুমি কামান আর মৃত্যুর গর্জনে উঠে বসেছো বিছানায়,
- তোমার সেই কালো ফ্রেমের চশমা পরেছো চোখে,
- লুঙ্গির উপর সাদা ফিনফিনে ৭ই মার্চের পাঞ্জাবী,
- মুখে কালো পাইপ, তারপর হেঁটে গেছো বিভিন্ন কোঠায়।
- সারি সারি মৃতদেহগুলি তোমার কি তখন খুব অচেনা ঠেকেছিলো?
- তোমার রাসেল? তোমার প্রিয়তম পত্নীর সেই গুলিবিদ্ধ গ্রীবা?
- তোমার মেহেদীমাখা পুত্রবধুদের মুজিবাশ্রিত করতল?
- রবীন্দ্রনাথের ভূলুন্ঠিত ছবি?
- তোমার সোনার বাংলা?
- সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবার আগে তুমি শেষবারের মতো
- পাপস্পর্শহীন সংবিধানের পাতা উল্টিয়েছো,
- বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে এক মুঠো মাটি তুলে নিয়ে
- মেখেছো কপালে, ঐ তো তোমার কপালে আমাদের হয়ে
- পৃথিবীর দেয়া মাটির ফোঁটার শেষ-তিলক, হায়!
- তোমার পা একবারও টেলে উঠলো না, চোখ কাঁপলো না।
- তোমার বুক প্রসারিত হলো অভ্যুত্থানের গুলির অপচয়
- বন্ধ করতে, কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য
- একজন কৃষকের এক বেলার অন্নের চেয়ে বেশি।
- কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য একজন
- শ্রমিকের এক বেলার সিনেমা দেখার আনন্দের চেয়ে বেশি।
- মূল্যহীন শুধু তোমার জীবন, শুধু তোমার জীবন, পিতা।
- তুমি হাত উঁচু করে দাঁড়ালে, বুক প্রসারিত করে কী আশ্চর্য
- আহবান জানালে আমাদের। আর আমরা তখন?
- আর আমরা তখন রুটিন মাফিক ট্রিগার টিপলাম।
- তোমার বক্ষ বিদীর্ণ করে হাজার হাজার পাখির ঝাঁক
- পাখা মেলে উড়ে গেলো বেহেশতের দিকে…।
- … তারপর ডেডস্টপ।
- তোমার নিষ্প্রাণ দেহখানি সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে, গড়াতে, গড়াতে
- আমাদের পায়ের তলায় এসে হুমড়ি খেয়ে থামলো।
- – কিন্তু তোমার রক্তস্রোত থামলো না।
- সিঁড়ি ডিঙিয়ে, বারান্দার মেঝে গড়িয়ে সেই রক্ত,
- সেই লাল টকটকে রক্ত বাংলার দূর্বা ছোঁয়ার আগেই
আমাদের কর্ণেল সৈন্যদের ফিরে যাবার বাঁশি বাজালেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন